বই পড়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা – হারিয়ে যাওয়া অভ্যাসে ফিরে দেখা

প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ দিন দিন বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। স্মার্টফোন, ট্যাব, টেলিভিশন—এইসব স্ক্রিনই এখন আমাদের বিনোদন ও জ্ঞানের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। অথচ, একসময় ছিল যখন মানুষ সন্ধ্যা নামলেই হাতে তুলে নিত একটি বই। তা গল্পের বই হোক বা জ্ঞানমূলক কিছু—বই ছিল প্রতিটি ঘরের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু আজ সেই দৃশ্য অনেকটাই বদলে গেছে। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে আজকের প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা অনেক কম। চলুন জেনে নেয়া যাক- বই পড়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। 

মন ও মস্তিষ্কের ব্যায়াম

বই পড়া কেবল সময় কাটানোর মাধ্যম নয়, এটি আমাদের মস্তিষ্কের ব্যায়ামের কাজ করে। আপনি যখন একটি বই পড়েন, তখন আপনার মস্তিষ্ক চিন্তা করে, কল্পনা করে এবং বিশ্লেষণ করতে শেখে। এটি স্মৃতিশক্তি বাড়ায়, বিশ্লেষণী চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে সমৃদ্ধ করে। বিজ্ঞান বলছে, যারা নিয়মিত বই পড়েন, তাদের মস্তিষ্ক অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয় ও স্বাস্থ্যবান থাকে।

একঘেয়েমি ও মানসিক চাপ থেকে মুক্তি

মানসিক চাপ, কাজের টেনশন, পারিবারিক দুশ্চিন্তা—এসব কিছু থেকে নিজেকে সাময়িক মুক্ত করতে চাইলে বই পড়ার বিকল্প নেই। একটি ভালো উপন্যাস আপনাকে নিয়ে যেতে পারে একেবারে অন্য এক দুনিয়ায়। আপনি বাস্তব থেকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও দূরে থাকতে পারবেন। বই হচ্ছে এমন এক বন্ধু, যে আপনাকে মানসিক শান্তি প্রদানে অনন্য ভূমিকা রাখতে  পারে।

চরিত্র গঠনে বই পড়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

বই পড়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি প্রমাণিত হয় চরিত্র গঠনে। বিশেষ করে শিশুকাল থেকে নৈতিক, ইসলামিক, ইতিহাস বা জীবনমুখী বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হলে তা ভবিষ্যতের জন্য দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বই পড়ার অভ্যাসের কারণে একজন পাঠক ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন সচেতন, ধৈর্যশীল এবং মানবিক। তিনি বুঝতে শেখেন সমাজের প্রতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে।

ভাষা, শব্দভাণ্ডার ও লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি

যারা বেশি পড়ে, তারা ভালো লেখে—এ কথা সত্যি। নিয়মিত বই পড়লে আপনার শব্দভাণ্ডার অনেক সমৃদ্ধ হয়, ব্যাকরণগত জ্ঞান উন্নত হয় এবং ভাষার প্রতি ভালোবাসা গড়ে ওঠে। আপনি যখন পড়তে পড়তে বিভিন্ন লেখকের লেখা দেখেন, তখন নিজের লেখার স্টাইলও উন্নত হয়।

ডিজিটাল আসক্তি থেকে দূরে রাখে

আজকের সমাজে ছোট-বড় সবারই ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তি এক প্রকার মহামারীর রূপ নিয়েছে। চোখের সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, মানসিক অস্থিরতা—এসবের মূলে আছে ডিজিটাল ডিভাইসের অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম। বই পড়া হলে সেই স্ক্রিন টাইম কমে যায়। চোখ ও মন দুটোই পায় প্রশান্তি।

আত্মবিশ্বাস ও চিন্তার পরিধি বৃদ্ধি

আপনি যখন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বই পড়েন, তখন সেই জ্ঞান আপনাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। আপনি যেকোন আলোচনায় অংশ নিতে পারেন, আপনার মতামত দিতে পারেন যুক্তিসহকারে। এছাড়া, বই আপনাকে শেখায় ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে। এটি আপনার চিন্তার পরিধিকে আরও অনেক বিস্তৃত করে।

🔁 কীভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন?

অনেকেই বলেন, “বই পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু সময় পাই না।” আমার মতে এটা একটা একটা অজুহাত ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা আমাদের জীবনে যা কিছুকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি সেটার জন্য যেকোনোভাবে সময় বের করে নিই। আপনি হয়তো কখনো বলবেন না যে, সময়ের অভাবে আমি এক সপ্তাহ ধরে খাবার খাইনি। কারণ আপনার যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন আপনি জানেন যে, অন্যান্য ব্যস্ততার থেকে খাবার খাওয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই আপনি শত ব্যস্ততার মাঝেও খাওয়ার জন্য ঠিকই সময় বের করে নেন। একইভাবে যদি আপনি সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন, অপ্রয়োজনীয় আড্ডা ইত্যাদির থেকে বই পড়াকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন তবে আপনি অবশ্যই এটার জন্য সময় বের করে নিতেন।

 নিচের কয়েকটি টিপস অনুসরণ করলে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা সহজ হবে:

  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট ৩০ মিনিট বই পড়ার সময় ঠিক করুন
  • প্রথমে হালকা ও আগ্রহজনক বই দিয়ে শুরু করুন
  • সবসময় একটি বই নিজের ব্যাগে রাখুন—বাসে, ট্রেনে বা অপেক্ষার সময় পড়তে পারবেন
  • বই পড়ার পর নিজের ভাষায় তার সারাংশ লিখে রাখুন
  • পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে বই নিয়ে আলোচনা করুন

আরো পড়ুন: বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার কারণ এবং সমাধান

 বই কেনার টাকা না থাকলে কি করবেন?

বই পড়তে আগ্রহী কিন্তু বই কেনার মতো সামর্থ্য নেই—এমন পরিস্থিতিতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ বিনামূল্যে বই পড়ার অনেক উপায় রয়েছে। আপনি চাইলে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই পড়তে পারেন। অনেক এলাকায় ফ্রি পাঠাগার, ইসলামিক সেন্টার বা স্কুল-কলেজের লাইব্রেরি থাকে, যেখান থেকে সদস্য হয়ে বই পড়া যায়।

বন্ধুদের সঙ্গে বই অদলবদল করাও এক দারুণ উপায়। এতে নতুন বই পড়ার সুযোগ যেমন মেলে, তেমনি সামাজিক বন্ধনও দৃঢ় হয়। এছাড়াও, অনলাইনে অনেক ইসলামিক, শিক্ষামূলক ও সাহিত্য বই বিনামূল্যে পিডিএফ আকারে পাওয়া যায়। বিশ্বস্ত সাইট বা অ্যাপে আপনি সহজেই এসব বই পড়তে পারবেন। 

Youtube থেকে ফ্রীতে অডিওবুক ডাউনলোড করে শোনাটাও একটা অন্যতম উপায় হতে পারে। এতে করে আপনি হাঁটতে হাঁটতেও বই পড়ার উপকারিতা লাভ করতে পারেন, যা সময়ের সদ্ব্যবহার করতে সাহায্য করে এবং একইসাথে আপনার জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়।

✅ বই হচ্ছে জ্ঞানের বাতিঘর

বই পড়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এখন আর শুধু একটা আদর্শগত বিষয় নয়—এটা একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ—সব পর্যায়ে বই পড়া আমাদের এগিয়ে নিতে পারে উন্নয়নের পথে। বই থেকে অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে গড়ে তুলতে পারি আদর্শ মানুষ হিসেবে। তাই আসুন, সব ধরণের অজুহাত বাদ দিয়ে প্রতিদিন অন্তত একটি পৃষ্ঠা হলেও বই পড়ি। শুরুটা হোক আজই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *